সোনাতলার ব্যতিক্রমী এক দরগার নাম ‘পাথর সাহেবের দরগা’

ইকবাল কবির লেমন
বাঙালি নদীর শাখা ঘেষা বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার নিভৃত পল্লী কাবিলপুর। এককালের গড় বেষ্টিত কাবিলপুরে গেলেই চোখে পড়ে দণ্ডায়মান দু’টি পাথর। সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার পাথর দু’টির কাছে গেলেই নাকে আসবে ফেলে রাখা বাসিদুধের গন্ধ, চোখে পড়বে দুধ-সিঁদুরের মিশ্রণে বিশেষ রং পাওয়া পাথর। ভাল করে দেখলে পাথর দু’টির কাছে পাওয়া যাবে আগোরবাতির বাক্স ও মোমবাতির পরিত্যক্ত অংশ। লতা ছড়ানো পাথর সংলগ্ন বটগাছের মোহনীয়তা আলাদা মাত্রা এনে দেবে যে কাউকে।
কাবিলপুরের সুদীর্ঘকালের দণ্ডায়মান পাথর দু’টি আগ্রহ তৈরি করছে মানুষের মনে। অনুসন্ধিৎসু মনকে ভাবিত করছে। অনুসন্ধানী মানুষ তাই নানা ভাবনায় ভাবিত হয়ে প্রতিদিন আসছে পাথর দু’টির কাছে।
‘জন্ম থেকেই পাথর দু’টি দেখছি’ এবং ‘অনাদিকাল থেকে প্রকৃতিপ্রদত্ত্ব পাথর দু’টি এখানে অবস্থান করছে’ পাথর দু’টির জন্মকাল নিয়ে কাবিলপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের এর বাইরে কোন আলোচনা নেই।
জন্মকাল নিয়ে সঠিক ধারণা না থাকলেও এলাকার মানুষ পাথর দু’টিকে প্রকৃতি প্রদত্ত মঙ্গলের প্রতীক মনে করে থাকে। এ বিশ্বাস থেকেই বিশ্বাসী মানুষেরা দীর্ঘদিন ধরে ভজনা করে আসছে পাথর দু’টিকে। বিশ্বাসীদের সেই অংশই প্রকৃতির মঙ্গল লাভের আশায় মানত হিসেবে পাথরের কাছে সমর্পণ করেন দুধ, কলা, বাতাসা, শিরনি। পাথরের গায়ে মাখিয়ে দেন সিঁদুর । মোমবাতি প্রজ্বলন করতেও দেখা যায় ভক্তকূলকে।
ঠিক কত বছর আগে থেকে পাথর বন্দনা শুরু হয়েছে সে বিষয়েও কেউ সঠিক কিছু বলতে পারে না। স্থানীয় লোকজনের কাছে পাথর সংলগ্ন স্থানটি পাথর সাহেবের দরগা’ হিসেবেই সমাদৃত।
সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী স্থানীয় একটি মহল মনে করেন, এই দু’টি পাথরেরই জীবন আছে। তাঁদের ধারণা, ‘পাথর দু’টির দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে , যেদিন পাথর দু’টি একসাথে যুক্ত হবে সেদিন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।’
সোনাতলার বাস্তববাদী বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষদের অভিমত, ‘প্রাচীনকালে এতদঅঞ্চল শাসনকারী কোন শাসকের হাতি বেধে রাখার জন্য পাথর দু’টি স্থাপন করা হয়েছিলো।’
অনেকে পাথর দু’টিকে পার্শ্ববর্তী স্থানে কথিত অধুনালুপ্ত নীলাম্বর রাজার বাড়ির দরজার অংশবিশেষ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। আবার অনেকেই পাথর দু’টিকে প্রাচীন শাসকদের কামান সংযোগের স্থান বলে মনে করে থাকেন।
পাথর বিষয়ে কথা হয় কাবিলপুর গ্রামের বাসিন্দা ও সমাজকর্মী আজাদ হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই পাথর দু’টিকে দেখে আসছি। আর দেখে আসছি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে কিছু মানুষকে সেখানে মানত করতে।’
ধারণা যাই হোক, প্রাচীন পুণ্ড্রনগরীর অতি নিকটস্থ কৈবর্ত্য, পাল, মোগলদের সম্পৃক্ততাসমৃদ্ধ গড়বেষ্টিত ঐতিহাসিক স্থান সোনাতলা। এই স্থানে এমন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন থাকা স্বাভাবিক- এমনটাই মনে করে আধুনিক প্রজন্ম।