পাড়া থেকে বেনারস– মোঃ আবু তালেব নয়ন

ছোট্ট একটা গ্রামে জন্ম নিয়েছি। ইট -পাথরের নগরী ভালোভাবে চেনা নেই। শহর -বন্দরে যাতায়াত খুবই কম। তবুও যে স্বপ্ন বহুদূর। তাইতো ছুটে চলা। টুয়েলভ পাশ পর্যন্ত গ্রামেই থাকা। মাঝে মাঝে শহরে যেতাম নিজের বই প্রকাশের জন্য। কিন্তু শহরের আবহাওয়া মেনে নিতে পারিনি। একদিকে এডমিশন নিয়ে বহু চিন্তা। বিভিন্ন জায়গায় এডমিশন টেস্ট দিলাম। মেইল আসলো ভারতের সুনামধন্য বিদ্যাপীঠ বানারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশনের সুযোগ হয়ে গেছে। কোন চিন্তা -ভাবনা ছাড়াই এডমিট হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পাসপোর্ট, ভিসাও জরুরি ভিত্তিতে হয়ে গেছে। বাবা – মা , আত্মীয়-স্বজন, পাড়া – প্রতিবেশী সকলের আশির্বাদ নিয়ে চলে গেলাম দূর প্রবাসে। যদিও আমাদের দেশের মানুষ ভারতকে কাছেই বলে। কিন্তু ভারত বিশাল বড় একটা দেশ। যেখানে পৌঁছা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ভারত বলতে আমাদের দেশের মানুষ শুধু কলকাতাকেই বুঝে। কলকাতার বাইরেও যে আরও ২৭ টি রাজ্য আছে সেগুলো সম্পর্কে কারো সঠিক ধারণা নেই। আমার গন্তব্য ভারতের উত্তর প্রদেশ বানারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় । বানারস সম্পর্কে অনেকেই পরিচিত। আমাদের মেয়েরা বেনারসী শাড়ি পড়তে ভালোবাসে। এই বেনারস থেকে বেনারসী শাড়ি তৈরি হয়। ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাড়ি বেনারসী শাড়ি। একই সাথে শহর টি পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। ভারতের ঐতিহ্য মিশে আছে বানারসের সাথে। একদিকে শ্রীমান রামের জন্মস্থান অন্যদিকে প্রত্নতত্ত্বে মহা নিদর্শন। সাড়া বেনারস যেন ঐতিহ্যের নিদর্শন। বেনারস ছাড়া ভারত কল্পনাও করা যায় না। হিন্দুদের আবেগের নাম বেনারস। আমাদের জন্য মক্কা – মদিনা যেমন আবেগ ও অনুভূতির নাম, ঠিক তেমনি হিন্দু সম্প্রদায়ের আবেগ হচ্ছে বানারস। এখানেই প্রবাহমান মূল গঙ্গা নদী। আমার ইউনিভার্সিটির পাশে দিয়েই চলছে ঐতিহ্যের বাহক গঙ্গা নদী। শহরটি ঘুরে অনন্য অভিজ্ঞতা হয়েছে। চারদিকে মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য শৈলী দেখে মনে হয় ফিরে যাই সেই যুগে। মুসলমানদের জন্যও রয়েছে অসংখ্য পুরাতন নিদর্শন। বিএইচইউ মানেই বানারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় । বিএইচইউ থেকে ৬ কি.মি দূরেই মুসলিম কলোনি খ্যাত ডালমুন্ডি অবস্থিত। সেখানে মুসলিমরা বসবাস করে। আমার জন্য একটা অনন্য আবেগের জায়গা। পুরাতন কবরস্থান, মাজার, সৌন্দর্যের নিদর্শনে ভরপুর ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ। বহুবছর আগের অসংখ্য পুরাতন মসজিদ আছে। তার মধ্যে শাহী আলমগীর জামে মসজিদ বহুবছরের পুরানো। যার বয়স অনুমান করা দূরহ ব্যাপার। পাশের জেলায় রয়েছে মুসলিমদের আবেগের আরেক নাম বাবরী মসজিদ। যা বর্তমানে অযোধ্যা বা রাম মন্দির নামে পরিচিত। একেবারেই ঐতিহ্যের বিশাল সমারোহ। চতুর্দিকে মন্দিরে ঘন্টার শব্দ। সন্ধ্যায় ছাদে যাই মাগরিবের আজান শোনার জন্য। সন্ধ্যা ও ফজরের আজান শোনা যায় ছাদ থেকে। আমার বাসা থেকে প্রায় তিন কি.মি. দূরে একটা মসজিদ। সব সময় মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া হয় না, বাসায় পড়তে হয়। অপরপক্ষে বিএইচইউ থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আরশি ঘাট। যেখানেই রাম বসবাস করতো। বানারসের জনপ্রিয় ঘাট। আমি সচোখে দেখেছি। অসংখ্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের গবেষণার জায়গা। এই ঘাট নিয়ে বহু কথা আছে। অন্য মাধ্যমে শুনাবো।
বানারসের প্রথম দিনের করুণ ইতিহাস শুনুন। কিভাবে পৌঁছালাম? বাড়ি থেকে ৩১ অক্টোবর ২০২২ তারিখে ভোরবেলা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ঢাকায় কিছুক্ষণ রেস্ট করলাম। একদিকে চোখে পানি, বাবা – মা, ভাই -বোন, আত্মীয় – স্বজন,এলাকাবাসী সবাই কে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমি সকলের কাছে আস্থাভাজন। সহজেই সকলের মন জয় করতে পারি। এটা সৃষ্টিকর্তার ( আল্লাহ ) রহমত। সকাল বেলা এলাকাবাসী সবাই বিদায় জানাতে আসলো। আমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মায়ের কান্না থামছেই না। আমি গাড়িতে চরার পর জানলাম মা অজ্ঞান হয়েছে। সেদিনের কথা কখনোই ভুলা সম্ভব নয়। যেই ছেলেটা কোন দিন বাড়ির বাইরে থাকেনি, সেই ছেলেটা দূর প্রবাসে চলে যাচ্ছে। সেদিন আমাকে সেই কষ্ট গুলো আটকাতে পারেনি, ছুটে চলছি জ্ঞান অর্জন করতে। ঢাকা কমলাপুর স্টেশন থেকে বেনাপোলের উদ্দেশ্য রওনা দিবো রাত আটটায়। সাথে ছিল মামাতো ভাই মুক্তার। ঢাকা থেকে ওরে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। আমি চললাম বেনাপোলের উদ্দেশ্য। আমি কোন কিছুই চিনিনা, শুধু আবেগে চলছি। বেনাপোলে পৌঁছালাম এক নভেম্বর সকাল ১০ টায়। তারপর আমার সাথে আরও তিনজন অচেনা বন্ধু যুক্ত হলো। বর্ডার ক্রস করে দুপুর বেলা ভারতে পা রখলাম। নতুন অনুভূতি আসলো। বাংলাদেশী টাকা এক্সচেঞ্জ করে ভারতীয় রুপি নিলাম। এখন বর্ডার এলাকা থেকে কলকাতার হাওড়ায় পৌঁছাতে হবে। একটা লাল টেক্সি নিয়ে হাওড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। হাওড়া ব্রিজের নাম সবাই কম বেশি শুনেছি। রাত দশটায় হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। যেখানে একটা হোটেলে উঠি। একরাত থাকার পর রওনা দিবো। রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম, সারাদিন অনেক জার্নি হয়েছে। শরীর টা অনেক ক্লান্ত। একদিকে বাড়ির কথা মনে পড়ছে। তখন আমার বয়স মাত্র ১৯ চলছে। এত কম বয়সে বড় একটা জার্নি সত্যিই ভেতরে ভয় কাজ করছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ফজর নামাজ পড়লাম, আল্লাহ কাছে সাহস ও ধৈর্য চাইলাম। সকালের নাস্তার পর ট্যাক্সি আসলো যেতে হবে হওড়া স্টেশন। ভারত বাংলা ছবিতে সবাই হাওড়া স্টেশন দেখেছি। ভারতের ঐতিহ্যবাহী রেল স্টেশন। আয়তনে বিশাল বড়। প্রচুর মানুষের আনাগোনা। এতবড় স্টেশন কখনোই দেখিনি। মাঝে মাঝে ভারত বাংলা ছবিতে দেখেছি। কল্পনা করছি এখানেই জিৎ , দেব প্রচুর ছবি করেছে। আবেগ দিয়ে বুঝার চেষ্টা করছি। তারপর অবশেষে ট্রেন আসলো। রাত আটটায় চড়লাম, উদ্দেশ্য বানারস। কলকাতা থেকে ১৬ ঘন্টা লাগবে বানারস যেতে। দুই তারিখ রাত আটটায় উঠলাম ট্রেনে তিন তারিখ বেলা বারোটায় পৌঁছালাম বেনারসে। ট্রেনের ভিতরে প্রত্যেক যাত্রীর জন্য আলাদা সিঙ্গেল বেড আছে ঘুমানোর জন্য। বানারস পৌঁছে গেলাম। রেল স্টেশন থেকে একটা হলুদ ট্যাক্সি নিয়ে চললাম ইউনিভার্সিটিতে। এত বড় ইউনিভার্সিটি কখনো দেখিনি। এত চমৎকার নান্দনিক সৌন্দর্য কখনো চোখে দেখিনি। আহ কি চমৎকার? একটু খোলা মনে সুখ নিতে থাকলাম। প্রথম কয়েক দিন শুধু ইউনিভার্সিটি ঘুরে দেখলাম। সাতাশ শত একর জমি নিয়ে বিশাল বড় ইউনিভার্সিটি। এশিয়ার সর্ববৃহৎ ইউনিভার্সিটির একটি। বিএইচইউ এর সভাপতি ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শ্রীমান নরেন্দ্র মোদী। বানারস থেকেই তিনি নির্বাচন করেন।
মোঃ আবু তালেব নয়ন
বিএইচইউ, বানারস, ভারত।