শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি

শব্দের বিষে নিস্তব্ধতার মৃত্যু: রুখতে হবে এখনই- রবিউল ইসলাম শাকিল

 

শব্দ দূষণকে প্রায়শই ‘নীরব ঘাতক বলা হয়। বায়ু বা পানি দূষণের মতো এটি দৃশ্যমান নয়, কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য সমান ভয়াবহ। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোতে যানবাহনের হর্ন, নির্মাণকাজ, উঁচু সাউণ্ডসিস্টেম এবং শিল্পকারখানার আওয়াজ নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে শব্দের মাত্রা ৮০-১০০ ডেসিবেল, যা গ্রহণযোগ্য সীমা (দিনে ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল) ছাড়িয়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ। এই শব্দের মাত্রা কেবল বিরক্তির কারণই নয়, জীবন ও প্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
কেন শব্দ দূষণ গুরুতর?
স্বাস্থ্যঝুঁকি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদে ৬০ ডেসিবেল-এর বেশি শব্দের সংস্পর্শে থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকি ৮% এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা ৫% বেড়ে যায়। বাংলাদেশ হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার ৩৮% বাসিন্দা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, যা শব্দ দূষণের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
শ্রবণক্ষমতা হ্রাস: জাতীয় কণ্ঠনালী ও শ্রবণ ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, রাজধানীর ১৫% শিশু এবং ২৫% রিকশাচালক শ্রবণস্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত।
মানসিক স্বাস্থ্য: জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল সাইকোলজির গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত শব্দের কারণে শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩০% বেশি হারে উদ্বেগ ও অবসাদ লক্ষ্য করা যায়।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য: বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ ফেডারেশনের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ঢাকার পার্কগুলোতে পাখির প্রজাতির সংখ্যা গত দশকে ৪০% কমেছে, যার অন্যতম কারণ শব্দ দূষণ।
শব্দ দূষণের উৎস:
যানবাহন: পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের তথ্য অনুসারে, ঢাকায় দৈনিক ৭২% শব্দ দূষণের উৎস যানবাহনের হর্ন। একটি গাড়ি গড়ে দিনে ৫০ বার হর্ন বাজায়, যা ইউরোপীয় শহরগুলোর তুলনায় ১০ গুণ বেশি (বিশ্ব ব্যাংক, ২০২২)।
নির্মাণকাজ: রাজধানীর ২৫% শব্দ দূষণ আসে রাতারাতি নির্মাণকাজ থেকে, যা আইনত নিষিদ্ধ হলেও প্রায়শই উপেক্ষিত হয়।
রাজনৈতিক সমাবেশ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান: বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যানার্সের মতে, রাজনৈতিক
মিছিলে ব্যবহৃত স্পিকার থেকে নির্গত শব্দের মাত্রা ১২০ ডেসিবেল ছাড়ায়, যা একটি জেট  প্লেনের ইঞ্জিনের শব্দের সমতুল্য।
অর্থনৈতিক প্রভাব/অদৃশ্য ক্ষতির হিসাব:
বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শব্দ দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়, যা চিকিৎসা খরচ, উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং শ্রবণযন্ত্র ক্রয়ে ব্যয় হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তথ্য মতে, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে শহরের ২০% হোটেল ও অফিস ভবন ভাড়া হারাচ্ছে।
সমাধানের উপায় কি?
বাংলাদেশের ‘শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬’ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ফই-এর নিচে রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ২০২৫ সালের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড় ও আতশবাজি ইত্যাদি শব্দদূষণের প্রতিকার চেয়ে ৯৯৯ এ মোট ১ হাজার ১৮৫টি কল করেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু প্রতিকার পেয়েছে ক’জন? তাই আইন যেমন রয়েছে, সে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগই শব্দ দূষনরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে আবার প্রয়োজনীয় সংস্কারও নিয়ে আসা যেতে পারে।
যার মাঝে রয়েছে:
১। হর্ন বন্ধে যৌথ অভিযান/মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা।
২। আমদানি নীতির আলোকে হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩। ট্রাফিক আইনে হর্ন বাজানোর শাস্তি বৃদ্ধি করা।
৪।শব্দের মানমাত্রানুযায়ী যানবাহনের ছাড়পত্র দেওয়া।
৫। চালকদের শব্দ সচেতনতার স্তর যাচাই সাপেক্ষে লাইসেন্স প্রদান করা।
৬। শব্দের মানমাত্রা হ্রাসে পদক্ষেপ গ্রহণ ব্যতীত শিল্প-কারখানা স্থাপনে ছাড়পত্র প্রদান না করা।
৭।অনুমতি ব্যতিত সভা-সমিতি ও সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক বাজানো নিষিদ্ধ করা।

কেবল আইনি পদক্ষেপ বা সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ দায়িত্ববোধ ও সচেতনতাও বড় ভ‚মিকা পালন করতে পারে। যেমন:
১. অনাবশ্যক হর্ন পরিহার: যানবাহনে হর্নের ব্যবহার কমানো, বিশেষ করে স্কুল-হাসপাতালের কাছে নীরব জোন মেনে চলা।
২. শব্দের উৎস নিয়ন্ত্রণ: বাড়ি বা গাড়িতে মিউজিকের ভলিউম যুক্তিসম্মত পর্যায়ে রাখা, কম শব্দযুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা।
৩. সমাজিক আচরণে পরিবর্তন: বিবাহ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাইকের ভলিউম কমানো, রাতে নির্দিষ্ট সময়ের পর উচ্চ শব্দ এড়ানো।
৪. প্রযুক্তির সুবিধা নেওয়া: উচ্চ শব্দে গান না বাজিয়ে, অন্যকে বিরক্ত না করে হেডফোন ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫. সচেতনতা সৃষ্টি: পরিবার ও সমাজে শব্দ দূষণের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আলোচনা করা এবং সবাইকে শব্দ দূষন এড়িয়ে চলতে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
সময় এখন সায়েন্স ফিকশনের মতো। আমরা যখন মহাকাশে বসতি খুঁজছি, তখন আমাদের নাগরিক সভ্যতা প্রতিদিন হারিয়ে ফেলছে প্রকৃতির সবচেয়ে মৌলিক সুর-নীরবতা। শব্দ দূষণ কোনো বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়; এটি আমাদের সমাজের অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা এবং উদাসীনতারই প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি অপ্রয়োজনীয় হর্ন, উৎসবের নামে কানে তালা লাগানো স্পিকার-এগুলো শুধু ডেসিবেলের পরিসংখ্যান বাড়ায় না, প্রকাশ করে আমাদের নৈতিক দেউলিয়াত্বকে। কিন্তু আশার কথা হলো, এই লড়াইয়ের হাতিয়ার আমাদেরই হাতে। একটু চেষ্টা করলেই ফিরে পাওয়া সম্ভব সকালের পাখির ডাক, পাতার মর্মর, শিশুর নির্মল হাসি। মনে রাখতে হবে প্রতিটি নীরব মুহূর্ত প্রকৃতির দেওয়া একটু প্রশান্তির শ্লোক। আইন-কানুনের চেয়ে বড় হাতিয়ার আমাদের সহমর্মিতা। গাড়ির হর্নে আঙুল না রেখে, উৎসবে শব্দের মাত্রা কমানো, নির্মাণকাজে সময় মেনে চলার এই ছোট ছোট সংযমই পারে শহরের গলিতে গলিতে নীরবতার ফুল ফোটাতে।
আসুন, আজ থেকে শপথ নেই: আমরা শব্দের দানব নই, নীরবতার সৈনিক। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে না বলে- ‘ওরা পৃথিবীকে বাঁচাতে পারত, কিন্তু ওরা কান ঢেকে রেখেছিল।’ নীরবতা হোক আমাদের উত্তরাধিকার, আমাদের প্রেমপত্র। কারণ, নিস্তব্ধতার মাঝেই লুকিয়ে আছে সভ্যতার আসল সৌন্দর্য-প্রাণের স্পন্দন।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button