বিশ্ব গণমাধ্যম দিবসে আমরা কতটা স্বাধীন-আবদুর রহমান টুলু

প্রয়াত এমপি আব্দুল মান্নান তাঁর বগুড়ার বাসায় ডাকলেন। তখন সকাল সাড়ে ৯টা। আমার সাথে একজন ফটো সাংবাদিক ছিলেন। এমপি মান্নান ভাইয়ের চায়ের টেবিলে ঢাকার কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ছিল সে সময়। নানা কথার মাঝে প্রয়াত এমপি মান্নান ভাই একটা দৈনিককে উদ্দেশ্য করে বললেন। জানো এই দৈনিকটা কেন পড়ি। এই দৈনিকে প্রতিদিন আমার সরকারের বিরুদ্ধে খবর থাকে। এজন্য কাগজটি সকাল সকাল পড়ি। দেখি আমার বিরুদ্ধেও কিছু লিখছে কি না। এভাবে আরো ৪ থেকে ৫টি দৈনিকের প্রধান শিরোনাম পড়লেন। আমি মনে মনে তাঁকে দৈনিকগুলোর সেরা পাঠক হিসেবে নির্বাচিত করলাম। কারণ, যে কাগজটি তাঁর এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে লেখে সে দৈনিকটিও তিনি নিয়মিত পড়েন। আসলে বিশ্ব গণমাধ্যম দিবসে আমরা কতটা স্বাধীন কতটাই মুক্ত হয়ে লিখছি এটা ভাবনার বিষয়।
বেশ কয়েকদিন আগে ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিক সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে সচিত্র প্রতিবেদনে তার প্রধান শিরোনাম হিসেবে প্রকাশ করলো। সেই কাগজটি বা তার সাংবাদিক স্বাধীনভাবে সংবাদটি তুলে ধরেছেন। পাঠক সেই সংবাদকে তাদের পণ্য হিসেবে কিনেছেন। এটাই স্বাধীন সাংবাদিকতা। বর্তমান সরকার সেই স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশাল বাজার তৈরি করেছেন। এজন্য সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। একমাত্র তিনিই মুক্ত সংবাদ ও সাংবাদিকতাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডলার কামানোর জন্য ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে গণমাধ্যমের পেশাদারি যথেষ্ট ক্ষুন্ন হয়েছে। দিন শেষে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জানার জন্য মানুষ ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয় বরং গণমাধ্যমেই বিশ্বাস করতে চান। আস্থা রাখছেন সকল গণমাধ্যমে। সেই আস্থা ধরে রাখা বেশ কঠিন। তাই ফেসবুক সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে সকল গণমাধ্যম কর্মিদেরকে।
গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যম নাগরিকের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখে। তথ্য জগতে তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। মানুষ জানতে চান। মানুষ সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চান। আর সেখানেই গণমাধ্যমের ভূমিকা। নীতিনির্ধারক, আইনসভাসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ ঘটাতে ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমে প্রতিফলিত হয় দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। স্বাধীনতার আগে এবং পরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম মানুষের প্রতিটি গণতান্ত্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের সঙ্গে থেকেছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যম নানা ঐতিহাসিক ঘটনায় মানুষের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছে। দুর্নীতি, সহিংসতা ইস্যুকে অনেক সময় গণমাধ্যমই সবার আগে মানুষের কাছে নিয়ে আসতে পেরেছে। এটি বগুড়ার সংবাদকর্মিরাই বেশি করেন।
পরিশেষে যে সকল গণমাধ্যমকর্মি আমাদেরকে ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন তাদের প্রতি সস্মান জানাচ্ছি। স্মরণ করছি আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা শিখানোর শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি আমাদের বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। প্রতি বছর ৩ মে বিশ্বজুড়ে এ দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। তথ্য জনগণের পণ্য এই স্লোগানে ২০২১ সালে এ দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়। মহামারি এবং জলবায়ুুর জরুরি অবস্থাসহ অন্যান্য সংকটময় সময়ে সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমকর্মীরা ক্ষতিকর ভুল এবং মিথ্যাচারকে মোকাবিলাসহ সকল তথ্যের দৃশ্যপট তুলে ধরতে সহায়তা করেন ।
সাংবাদিকতা হলো একটি গণসম্পদ। মহামারির অর্থনৈতিক প্রভাব অনেক প্রচার মাধ্যমকে কঠোরভাবে আঘাত করেছে। যা তাদের অস্থিত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। এছাড়া বাজেট সংকটের সঙ্গে সঙ্গে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়াও কঠিন হচ্ছে। এ শূন্যস্থান পূরণ করতে গুজব, মিথ্যা এবং চূড়ান্ত বা বিভাজিত মতামত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার তাদের ক্ষমতানুযায়ী একটি মুক্ত, স্বাধীন এবং বহুমুখী প্রচার মাধ্যমকে সমর্থন করেছেন এ জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ মোতাবেক ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় (৩মে) তারিখটিকে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের স্বীকৃতি দেয়া হয়। দিবসটি উপলক্ষে জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় থেকে একই বছরের (২মে) মহাসচিবের একটি বার্তাও প্রচার করা হয়েছিলো।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাতে শক্তিশালী, স্থিতিশীল সমাজ গঠনে নির্ভরযোগ্য সর্বজনীন ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশের গনমাধ্যম কর্মিরা। বিশেষ করে আমরা যারা বগুড়ায় গণমাধ্যমকর্মি আছি আমাদের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত ছিলাম। তারপরও আমরা বগুড়াবাসিকে করোনায় সবসময় আপডেট খবর দিয়েছি ।
ভুল তথ্যে অপপ্রচাররোধে মুক্ত এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা আমাদের সবচেয়ে শক্তি। জাতিসংঘ সাংবাদিক নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা। কারণ তথ্য হচ্ছে এটি গণসম্পদ। একটি মুক্ত এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যম উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনা সরকার কাজ করছেন।
এখনো মানুষের অন্যতম ভরসার নাম গণমাধ্যম। যখন দেশের রাজনীতি বেহাত হয়ে যায়, রাষ্ট্রের সবকিছু ভেঙে পড়ে, বিপন্ন মানুষের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা থাকেনা। তখন গণমাধ্যমই হয় তার সবশেষ আশ্রয়। মানুষ এখনো বিশ্বাস করে। সাংবাদিকরা যদি তার সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তাহলে কেউ না কেউ ওই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবেন। এই বিশ্বাস এখনো মানুষের মনে আছে। নানা সংকটের পরেও, নানা সীমাবদ্ধতা ও বিতর্কের পরেও গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের এই আস্থাটি আছে। যদিও সেই আস্থার সংকটও আছে।
গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যম নাগরিকের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখে, তথ্য জগতে তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। মানুষ জানতে চায়, মানুষ সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চায়। আর সেখানেই গণমাধ্যমের ভূমিকা। নীতিনির্ধারক, আইনসভাসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ ঘটাতে ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমে প্রতিফলিত হয় দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা। স্বাধীনতার আগে এবং পরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম মানুষের প্রতিটি গণতান্ত্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের সঙ্গে থেকেছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যম নানা ঐতিহাসিক ঘটনায়, মানুষের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছে। দুর্নীতি, সহিংসতা ইস্যুকে অনেক সময় গণমাধ্যমই সবার আগে মানুষের কাছে নিয়ে আসতে পেরেছে।
এ দেশের একজন সাংবাদিককে এক নিরন্তর লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে তার দিন, মাস,বছর পার করতে হয়। এ লড়াই নিজের সঙ্গে, সঠিক সাংবাদিকতা সে করতে পারছে কিনা। প্রতিটি স্তরে তাকে বুঝে নিতে হয় কত কঠিন তার এই পেশা। মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সময় ব্যয় করতে হয় সম্পাদক ও সাংবাদিকদের।
গণমাধ্যম অর্থনীতি নতুন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে নিয়মিত। সংবাদপত্র পাঠকের স্বল্পতা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। সংবাদপত্রের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখাই এখন আরেক লড়াই। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠের অভ্যাস কমছে। কমছে দেশীয় টেলিভিশন দেখা। বাড়ছে ফেসবুক সাংবাদিকতা। বিজ্ঞাপন যাচ্ছে অন্য মাধ্যমে। অর্থের ঝাঁকুনি খাচ্ছে মুল ধারার গণমাধধ্যম।
কিন্তু আমরা জানি না নিজেদের আকাশে জমে থাকা মেঘ কাটবে কবে। জানিনা গণমাধ্যমে আমরা কতটাই স্বাধীন।
লেখক
আবদুর রহমান টুলু
সিনিয়র রিপোর্টার
বাংলাদেশ প্রতিদিন
বগুড়া ব্যুরো
ও
বিশেষ প্রতিনিধি (উত্তরাঞ্চল)
বিসনেস আই।
মোবাইল-০১৭১২-৬৮৪৫৬৪
tulubogra@gmail.com