জাতীয়

ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকদের বঞ্চনার অবসান হবে কবে?

বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ধারার একটি ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার নাম স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রম। দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন কোটি কোটি ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষদের আশাবাদী করেছিলো। এদেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিলো এই কার্যক্রমের মাধ্যমে একদিকে যেমন শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি অনন্য ধারা তৈরি হবে, ইসলামের অনুশাসন বাস্তবায়নে সবসময় তৎপর থাকবে একদল মানুষ, ইসলামের নীতি-আদর্শ প্রচারিত হবে সর্বত্র। পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা মর্যাদার জীবন-যাপন করবে। কিন্তু বিধি বাম। সরকার আসে, সরকার যায়। শুধু আশ্বাসের ফুলঝুরিতে কেটে যায় দ্বীন-ইসলাম প্রচারকারী ও মানুষ গড়ার কাগির স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের। ২০২৪ সালে নতুন বৈষম্যবিরোধী একটি নতুন দেশের সূচনা হলে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীরা আবারও আশায় বুক বাঁধে। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবি জানায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একাধিকবার দাবির সমর্থনে আশ্বাস প্রদান করলেও বারবার আন্দোলনে নামতে হচ্ছে মানুষ গড়ার ও ইসলাম প্রচারের কারিগর অন্তর্বর্তীকালীন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের। আন্দোলনে গিয়ে হামলার শিকার হতে হচ্ছে অভুক্ত শিক্ষকদের। একাধিকবার জাতীয়করণের দাবিতে তেমন কাজের কাজ না হওয়ায় শেষবারের মতো ঢাকায় একটানা বিশদিনের স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনে রয়েছে শিক্ষকরা। তবুও যেন মন গলছেনা কর্তৃপক্ষের। অবস্থা দৃষ্টে সচেতন মানুষের মনে বারবার প্রশ্ন আসছে ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান হবে কবে?

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার প্রেক্ষাপট
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বাক্ষরিত মাদ্রাসা শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৯৭৮ এর প্রদত্ত ক্ষমতা বলে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক বছর পর ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে মাদ্রাসা শিক্ষা অধ্যাদেশ ১৯৭৮ এর ১৭ (২) (বি) ধারার প্রদত্ত ক্ষমতা বলে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তর ফোরকানিয়া মাদ্রাসা সূমহ এবং নতুন করে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা নামকরণ করে ১৯৮৪ সাল হতে মঞ্জুরী প্রদান শুরু করেছিল ।
১৯৮৪ সাল হতে মঞ্জুরী প্রদান শুরু করলেও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের কোন বেতন ভাতা ছিল না। ১৯৯১ সালে বিএনপি তথা বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করার পর ১৯৯৪ সালে অবহেলিত এবং বেতন বিহীন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা সূমহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ বাধ্যতামুলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ইউনিট এর অধিনে (স্মারক নং শাঃ ৩/২ এম-২২/৯৩/৫৫৯ তারিখঃ ০৮/০৫/১৯৯৪ পত্র মূলে) প্রতিটি ইউনিয়নে ১ টি করে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা অনুদান দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। উপজেলা ও জেলা যাচাই বাছাই কমিটির বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে প্রায় ৪৫০০ হাজার ইউনিয়নের মধ্য হতে সারা দেশে মাত্র ১৫১৯ টি মাদ্রাসা অনুদানভুক্ত করা হয়। শিক্ষকদের অনুদান মাসিক বেতন ৫০০/ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এখানে উল্লেখ্য বে-সরকারি রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একই আদেশের বলে ৫০০/- টাকা অনুদান শুরু হয়েছিল । ১৯৯৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদা হলে বে-সরকারি রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিনে চলে যায়। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সূমহ শিক্ষান্ত্রণালয়ের অধিনেই থাকে। আওয়ালীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সূমহের আর কোন সুযোগ সুবিধা প্রদান করেনি।
২০০১ সালে বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর ২০০২ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেয়া শুরু করে। ২০০৩ সালে সবার জন্য শিক্ষার আওতায় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সূমহের সকল শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ শুরু করে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বে-সরকারি রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ভাতা ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করতে থাকে সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৯ই জানুয়ারী ২৬১৯৫ টি রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয় একই মানের মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সমূহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকায় সারাদেশে একটি মাদ্রাসা জাতীয়করণ করেনি। ২০১৫ সালে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদা হয়। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সূমহ মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের উপর ন্যাস্ত করা হয়। অদ্যাবধি পর্যন্ত মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা সমূহের প্রশাসনিক দায়িত্ব দেখাশোনা করছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার একমুখী শিক্ষা চালু হলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার পাঠ্যবই একই হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় অতিরিক্ত তিনটি পাঠ্যবই আলাদা পাঠদান করানো হয় যেমন- আরবি, কোরআন ও তাজবীদ এবং আকাঈদ ফিকাহ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সমূহের স্কুল খোলার সময় সকাল ১০ টা এবং বন্ধের সময় বিকেল ৪ টা। ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সমূহের সমাপনি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সমূহের বাৎসরিক ছুটি প্রায় একই। অতি স¤প্রতি অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সমূহের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি সমপর্যায়ে চালু করতে যাচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সমূহের বেতন বৈষম্য অনেক। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার একমুখী শিক্ষার কারিকুলামে পাঠদান করে বিধায় প্রাথমিক শিক্ষার বৈষম্য দূরীকরণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ন্যায় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণ করা অপরিহার্য।

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল ¯্রােতের সাথে ন্যয্যতার ভিত্তিতে সত্যিকার অর্থে একীভূতকরণের মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধকে জারি রাখা এবং আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। ৯০% মুসলমানের দেশে মাদ্রাসা ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও হবে, জাতীয়করণ হবে এটাই জাতির প্রত্যাশা। ইসলামী শিক্ষার প্রসার ঘটলে সমাজে অন্যায়-অবিচার দূর হবে, আইন শৃঙ্খলার উন্নতি হবে। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে জাতি। ৪০ বছর ধরে খেয়ে না খেয়ে ইবতেদায়ী মাদ্রাসায় যারা কাগজ কলম খাতা পেন্সিল সংরক্ষণ করে রেখেছে, প্রতিষ্ঠান ধরে রেখেছে তাদের দিকে সুনজর দেয়ার সময় এসেছে। অন্য চাকরিজীবীরা বেতন পেলেও পুনরায় যেখানে বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করছে সেখানে ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলি এমপিওভূক্তির ন্যায্য দাবি করছে মাত্র। বাংলাদেশের ১৫১৯ টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা নামমাত্র অনুদানভুক্ত বাকি গুলি অনুদানবিহীন থাকলেও বিগত সময়ে সেদিকে মোটেই নজর না দিয়ে একসাথে ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করা হয়েছে।

২০২৫ সালের ২৮ জানুয়ারি অন্তবর্তীকালীন সরকার সকল স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্তএমপিও কার্যক্রমই সমাপ্ত হয়নি। বর্তমান সরকার ২৫-২০২৬ অর্থবছরে ৭২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও কাজের কোন অগ্রগতি নেই। বাধ্য হয়ে এই সেক্টরের প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষক আন্দোলনে নেমেছে। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত্রি যাপন করে এগিয়ে চলছে আন্দোলন।
যেকোন জাতির উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষা আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। একটি ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি গঠনে এখনই ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে তাঁদেরকে ঘরমুখী করণের মাধ্যমে ইসলামী ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রাখা প্রয়োজন।
এখনই জাতীয়করণ করা উচিৎ ন্যায্য দাবিদার ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোকে। এখনই অবসান হওয়া উচিত ‘ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান হবে কবে?’ জাতীয় প্রশ্নের।

লেখক, ছাইফুল ইসলাম, চেয়ারম্যান টিজিএ এস (বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button