আধুনিকতায় হারিয়ে যাচ্ছে ধুনটের মৃৎশিল্প

রাকিবুল ইসলাম,ধুনট বগুড়া প্রতিনিধি
দেশের প্রাচীনতম শিল্পের মধ্যে মৃৎশিল্প একটি। তৎকালীন সময়ে মৃৎশিল্পের কারিগরেরা কুমার বা পাল নামে বংশ পরিচয় লাভ করেন। যুগ যুগ ধরে এ পেশার সঙ্গে জড়িত কারিগররা তাদের গভীর ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে সুনিপুন হাতের বিভিন্ন কারুকাজের মাধ্যমে মাটি দিয়ে তৈরি করেন নানা তৈজসপত্র। কিন্তু কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মৃৎশিল্পটি দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে।
আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মাটির তৈরি এসব জিনিসের বদলে বাজার দখল করছে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল ও সিরামিকসহ অন্য সব সামগ্রী। তাই আধুনিক প্রযুক্তির তৈজসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মাটির তৈরি অনেক পণ্যই হারিয়ে গেছে। কিন্তু মাটির তৈরি কিছু তৈজসপত্র এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। শহরবাসীর দালান-কোটা সাজাতে মাটির তৈরি নানা পট-পটারি, ফুলদানি ও বাহারি মাটির হাঁড়ির কদর রয়েছে এখনো।
সরে জমিনে জানা যায়, ২৫ বছর আগেও ধুনট উপজেলায় মৃৎশিল্পের দাপট ও কদর দুটোই ছিল। তখন উপজেলার সদরও ইউনিয়নে প্রায় ১২০জন পরিবার মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করত। ওই সময় উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটির তৈরি এসব তৈজসপত্র সরবরাহ করা হত।
কিন্তু বর্তমানে এ উপজেলায় প্রায় ২০ পরিবার মৃৎশিল্পের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। আগের মতো চাহিদা আর পারিশ্রমিকের ন্যায্যমূল্য না থাকায় এ পেশার লোকজন অত্যন্ত দুঃখ-দুর্দশা আর হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ পেশায় কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় অন্য পেশায় তেমন খাপ খাওয়াতে পারছেন না তারা। কম লাভ জেনেও শুধু পারিশ্রমিকের আসায় বাপ-দাদার পুরানো ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো মাটি দিয়ে তৈরি করছেন বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি, সরা, কলস, বাসন, মুড়ি ভাজার খোলা, কোলা, ভাটি, পিঠা তৈরির খাঁজ, জালের কাঠি, মাটির ব্যাংক ও জলকান্দা ইত্যাদি।
মাটি সোনার চেয়েও খাঁটি। মাটির সামগ্রীতে মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের অনুভূতি, প্রেম-বিরহের নানা দৃশ্যপট, মনোমুগ্ধকর ছবি হাতের স্পর্শে ফুটিয়ে তুলতেন শিল্পীরা। অথচ আজ উপজেলা বিভিন্ন এলাকায় এখন পুঁজির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এখানকার মৃৎশিল্প। এই পেশায় এখন ভর করেছে অভাব-অনটন। মেলা-পার্বনেও তেমন চাহিদা নেই মাটির তৈজসপত্রের। তবে কিছু হোটেল-মিষ্টির দোকানে এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজায় এখনও প্রয়োজন হয় মাটির সামগ্রীর। পহেলা বৈশাখে মাটির সরাইয়ে (সানকি) তে পান্তাভাত খাওয়ার রীতিও চালু আছে।
একটা সময় ছিল বাংলা নববর্ষকে ঘিরে নির্ঘুম ব্যস্ত সময় পার করতেন বিল কাজলী মৃৎশিল্পীরা। পহেলা বৈশাখ বাঙালির নববর্ষ। নববর্ষ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বসে বর্ষবরণ মেলা। সেই মেলায় চাহিদা থাকে নানা রকমের খেলনা, মাটির জিনিসপত্রের। মেলাকে দৃষ্টিনন্দন করতে মৃৎশিল্পীরা নিজের হাতে নিপুণ কারুকাজে মাটি দিয়ে তৈরি করতেন শিশুদের জন্য রকমারি পুতুল, ফুলদানি, রকমারি ফল, হাঁড়ি, কড়াই, ব্যাংক, বাসন, থালা, বাটি, হাতি, ঘোড়া, বাঘ, টিয়া, ময়না, ময়ূর, মোরগ, খরগোশ, হাঁস, কলস, ঘটি, চুলা, ফুলের টবসহ মাটির বিভিন্ন তৈজসপত্র।
উপজেলার নিয়ামতি এলাকায় মৃৎশিল্পের সঙ্গে এখনো জড়িত রয়েছে প্রায় ২০ পরিবার। তারা বিভিন্ন উৎসবসহ মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন এখনো। তাই এখানে পুরুষ মৃৎশিল্পীর পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে কাজ করছেন।
প্রায় দুইশত বছর আগে থেকে বাপ দাদার আমল হতেই মৃৎশিল্পীর কাজ চলে আসছে। বর্তমানে বাজারে চাহিদা কম এখন আর আগের মত ব্যবসা নাই।
নিয়ামিতো বিলকাজুলীর রতিকান্ত পালের পুত্র সৌরভ পাল জানান,
বর্ষা মৌসুমে আমরা চরম ভোগান্তিতে পড়ি। কাঁচামাল রোদে শুকাতে হয়। বারবার বৃষ্টি আসাতে তেমন শুকানো যায় না। বাজারও থাকে খুব খারাপ তেমন বেচাকেনাও হয় না। অর্ধ হারে অনাহারে আমাদের জীবন চলে।