সম্পাদকীয়জাতীয়
সর্বশেষ সংবাদ

আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলার নারীদের অদম্য পথচলা- রবিউল ইসলাম শাকিল

আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলার নারীদের অদম্য পথচলা- রবিউল ইসলাম শাকিল

বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে নারীর উপস্থিতি শুধু প্রান্তিক অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা প্রাণসঞ্চারী শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে।

ব্রিটিশ আমলের বিপ্লবী আন্দোলন থেকে শুরু করে একুশ শতকের ডিজিটাল যুগের গণঅভ্যুত্থান—প্রতিটি সংগ্রামে নারী তার রাজনৈতিক চেতনা, সাহস ও সংগঠনশক্তির মাধ্যমে ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই গৌরবগাথার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই শুধু নয়, বর্তমান প্রজন্মের জন্য তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলার নারী সমাজ যখন পর্দার অন্তরালে আবদ্ধ, ঠিক তখনই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দেন অন্ধকারে। তাঁর ‘সুলতানার স্বপ্ন’ শুধু কল্পনাই নয়, নারীমুক্তির রূপরেখা হয়ে ওঠে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে রানী ভবানী, নবাব ফয়জুন্নেসা-র মতো নারীরা শাসকশ্রেণির অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পূর্ব বাংলার নারীদের রাজনৈতিক জাগরণ তীব্রতর হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে সুফিয়া কামাল, রাবেয়া খাতুন-এর নেতৃত্বে নারীরা রক্তাক্ত সকালে অকুতোভয় মিছিল নিয়ে এগিয়েছেন। মায়েরা সন্তানকে কোলে নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্লোগান দিয়েছেন—এ দৃশ্য কেবল ইতিহাসের পাতায় নয়, বাঙালির হৃদয়ে অম্লান হয়ে আছে।

১৯৭১ সালে নারীর ভূমিকা ছিল বহুমাত্রিক। দুই লাখের বেশি নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও হাজার হাজার নারী সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। তারামন বিবি, ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম, শিরিন বানু মিতিল-এর নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও, অনেক বীরাঙ্গনা আজও রয়ে গেছেন নামহীন।

নব্বইয়ের দশকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পরও নারীর সংগ্রাম থেমে থাকেনি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যৌতুকবিরোধী আইন, অ্যাসিড নিক্ষেপ প্রতিরোধে কঠোর শাস্তির দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম-এর নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়—যা শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনই নয়, নারীর নেতৃত্বে জাতীয় চেতনার পুনরুত্থানেরও উদাহরণ। একুশ শতকে এসে নারী আন্দোলনের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবিতে সোচ্চার হওয়া নারী কর্মীরা কিংবা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সাইবার হয়রানির বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন—সবখানেই নারী তার অধিকারের প্রশ্নে অনড়।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান এই ধারাবাহিকতারই নতুন অধ্যায়। যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের দমনপীড়ন চরমে, তখন স্কুলের ইউনিফর্ম পরা কিশোরী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, গৃহিণী—সবাই মিলে রুখে দাঁড়িয়েছেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। পুলিশের বেয়নেট আর টিয়ার শেল উপেক্ষা করে নাজিফা জান্নাত, উমামা ফাতেমা-র মতো তরুণীরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু যেই পরিমাণ নারী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে, তাদের খুব কম সংখ্যকই বর্তমান রাজনীতিতে সক্রিয়। এর পেছনে কারণ কী? নারীদের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর অবজ্ঞা, নাকি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব?

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, শুধু ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এই ১৮৯ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৮টি ধর্ষণ, ১১টি দলবদ্ধ ধর্ষণ। একটি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে— কোন শব্দ দিয়ে বর্ণনা করব এই নৃশংসতা? যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্ত করে আত্মহত্যায় বাধ্য করা—এসব কি শুধু আইনের ফাঁকফোকর দেখে বেড়ে ওঠা অপরাধ, নাকি সমাজের নৈতিক পতনের প্রতিচ্ছবি? কারণ কী? ভয়? লজ্জা? নাকি বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত এক সমাজের নির্মম পরিণতি? সাইবার জগতেও নারীরা নিরাপদ নয়—অপপ্রচার, ডক্সিং ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এই সংকট মোকাবিলায় আইনের কঠোর প্রয়োগ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। নারী নির্যাতনের মামলাগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। ধর্ষণের মামলায় ১৮০ দিনের মধ্যে রায় দেওয়ার আইন আছে, কিন্তু বাস্তবে তা কতটা কার্যকর? মাসের পর মাস ঘুরতে হয় আদালত পাড়ায়, ধর্ষিত নারীর জীবনীশক্তি ফুড়িয়ে আসে সঠিক বিচার পেতে! এজন্য প্রয়োজন ১৮০ দিনের মধ্য ধর্ষনের মামলায় রায় প্রদান করা এবং থানায় নারীরা যেন সাহস পায়—এলক্ষ্যে প্রতিটি থানায় নারী অফিসারকে দায়িত্ব দিন স্বচ্ছন্দ্যে অভিযোগ নেওয়ার জন্য।

ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং ও ক্ষুদ্র উদ্যোগে নারীরা বিপ্লব ঘটালেও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য এখনো রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক। মজুরিবৈষম্য, মাতৃত্বকালীন সুবিধার অভাব এবং যৌন হয়রানির মুখে অনেক নারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। ২০২৫ সালের মধ্যে নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়াতে সহজ শর্তে ঋণ, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, গণিত) ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে তাদের উপস্থিতি মাত্র ৩০-৩৫% (ইউজিসি, ২০২৩)। বাংলাদেশকে ডিজিটাল করতে হলে নারীদের এই খাতে এগিয়ে আনতে স্কলারশিপ, মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম এবং নারী-বান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরি জরুরি।

বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাস শুধু রক্তাক্ত সংগ্রামেরই নয়, তা অদম্য আশারও গাথা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যেসব নারী স্লোগান দিয়েছিলেন “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, ১৯৭১-এ যারা মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন, আর ২০২৪-এ যারা রাস্তায় নেমে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন—তাদের সবাই একই সূত্রে গাঁথা। এই সূত্রটি হলো অধিকার আদায়ের লড়াই, যা কোনো কালেই থামেনি।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বার্তা স্পষ্ট—নারীর অগ্রযাত্রাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ইতিহাস সাক্ষী, বাংলার নারী যখন জেগেছে, সে পাহাড় সরিয়েছে। রোকেয়ার কলম, সুফিয়া কামালের সাহস, তারামন বিবির বন্দুক, জাহানারা ইমামের প্রতিবাদী কণ্ঠ, আর আজকের নাজিফা-উমামাদের টিয়ার শেল উপেক্ষা করা মিছিল—এই ধারাবাহিকতাই আমাদের পাথেয়। তবে শুধু আইন বা নীতিতে নয়, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে সমাজের প্রতিটি কোণে। বাড়ির উঠানে, কর্মক্ষেত্রের ক্যান্টিনে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে কিংবা রাজনীতির মঞ্চে।

রবিউল ইসলাম শাকিল

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ,বগুড়া।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button